‘মিনিকেট’ নামে ধানের কোনো জাত নেই
বাজারে মিনিকেট নামের যে চাল কিনে ক্রেতারা খাচ্ছেন সে সম্পর্কে
জানলে আঁতকে উঠতে হবে! বাংলাদেশ কিংবা ভারত কোন দেশেই মিনিকেট নামে ধানের কোন জাত
নেই। মূলত একশ্রেণির চালকল মালিক ভোক্তাদেরকে বোকা বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মোটা চাল
ছেঁটে সরু করে তা মিনিকেট নামে চালিয়ে যাচ্ছে।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর তথ্যমতে, “দেশের নানা অঞ্চলে ধান গবেষণা
ইনিস্টিটিউট উদ্ভাবিত জাতগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার ভারতীয় জাতের ধান চাষ হয়।
কিন্তু মিনিকেট নামে ধানের কোনো জাত দুদেশের কোথাও নেই। এ নামটি একটি গুজব।”
মিনিকেট নামের উৎপত্তি নিয়ে কৃষিবিদ খোন্দকার সিরাজুল করিম জানান,
“১৯৯৫ সালের দিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ভারতের কৃষকদের মাঝে সে দেশের
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নতুন জাতের চিকন শতাব্দী ধানবীজ বিতরণ করে। মাঠপর্যায়ে
চাষের জন্য কৃষকদেরকে এ ধানবীজের সঙ্গে আরো কিছু কৃষি উপকরণসহ একটি মিনিপ্যাকেট প্রদান
করে ভারতীয় সরকার।”
তিনি আরো বলেন, “মিনিপ্যাকেটে করে দেয়ায় ভারতীয় কৃষকদের কাছে এ ধান
শেষমেষ মিনিকিট বলে পরিচিতি লাভ করে। কৃষকরা মিনিপ্যাকেট শব্দটির মধ্য থেকে ‘প্যা’
অক্ষরটি বাদ দিয়ে মিনিকেট বলে পরিচয় দিতে শুরু করে।”
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বোরো মৌসুমে চাষযোগ্য এ ধানবীজ
সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের কৃষকদের হাতে পৌঁছায়। ঝিনাইদহ জেলার সীমান্তবর্তী
মহেশপুর উপজেলার চাষিরা সর্বপ্রথম এ ধানবীজ চাষ শুরু করে। দেশে আগে নাজির শাইল,
পাজাম ও বালাম ধানের চাষ হতো। এসব দেশি সরু ধানের চালের ব্যাপক চাহিদা ছিল।
সূত্র আরো জানায়, বরিশালে বালামের সুনাম ছিল সারা ভারত উপমহাদেশ
জুড়ে। কালের বিবর্তনে সেসব সরু জাতের ধানচাষ উঠে যায়। তবে সরু চালের সন্ধান করতে
থাকে ক্রেতারা। এসময় বাজারে কথিত মিনিকেটের আর্বিভাব ঘটে। ক্রেতারা লুফে নেয় এ সরু
জাতের চাল। সুযোগ বুঝে একশ্রেণির মিলমালিক মাঝারি সরু বি আর- ২৮, বিআর- ২৯ ও বি
আর-৩৯ জাতের ধান ছেঁটে মিনিকেট বলে বাজারজাত করতে শুরু করে। বর্তমানে সারাদেশে
চিকন চাল বলতে এখন মিনিকেটই বোঝায়, যার দামও চড়া।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, যশোর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা ও
চুয়াডাঙ্গায় কথিত মিনিকেট ধানের চাষ হয়। গত বোরো মৌসুমে যশোর জেলায় ৩০ হাজার
হেক্টরে, ঝিনাইদহ জেলায় ১৮ হাজার হেক্টরে, চুয়াডাঙ্গা জেলায় তিন হাজার হেক্টরে ও
মাগুরা জেলায় এক হাজার হেক্টর কথিত এ মিনিকেট ধানের চাষ হয়। সর্বমোট এ অঞ্চলে ৫৫
হাজার হাজার হেক্টরে মিনিকেট চাষ হয়েছিল। হেক্টর প্রতি গড় ফলন ছিল ৩ দশমিক ৬২
মেট্রিক টন।
ঝিনাইদহের ডাকবাংলা বাজারের চালকল ব্যাবসায়ীরা জানায়, যশোর,
ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা ও মাগুরা জেলা ছাড়া অন্য কোনো জেলায় মিনিকেট ধান
উৎপাদন হয় না। গত বোরো মৌসুমে ধান ওঠার পর প্রতিমণ মিনিকেট ধানের দাম ছিল সাড়ে
সাতশ থেকে আটশ টাকা। আর সে সময় প্রতিকেজি মিনিকেট চাল পাইকারি ৩৪-৩৫ টাকা দরে
বিক্রি হয়। একশ্রেণির চালকল মালিক বিআর-২৯ ও বিআর-৩৯ জাতের চাল ফিনিশিং করে
মিনিকেট বলে বাজারজাত করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়ার খাজানগর, পাবনা,
নওগাঁ প্রভৃতি স্থানের চালকল থেকে সারাদেশে কথিত মিনিকেট চালের সরবরাহ করা হচ্ছে।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, লাখ লাখ মন এই মিনিকেট চালের যোগান কোথা থেকে আসছে।
ঝিনাইদহ মেছুয়া বাজারের আড়তদাররা জানায়, অটো রাইচমিল মালিকরা কথিত
মিনিকেট বলে যে চাল সরবরাহ করছে তারাও মিনিকেট বলে তাই বাজারে বিক্রি করছেন। তবে এ
নামে সরকার অনুমোদিত কোনো জাতের ধান নেই। বিআর ২৮, কল্যানী, রত্না, বেড়ে রত্না,
স্বর্ণা, গুটি স্বর্ণা, লাল স্বর্ণা আইআর ৫০, জাম্বু ও কাজললতা জাতের ধান ছেঁটে
মিনিকেট বলে বিক্রি করা হচ্ছে।
কৃষি বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা আহম্মেদ হোসেন বলেন, “পাঁচ বছর আগে
সুপার ফাস্ট নামে বোরো মৌসুমে চাষের জন্য ভারতের ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট একটি সরু
জাতের ধান অবমুক্ত করে। এ ধানের চাল একশ্রেণির মিলমালিক সুপার মিনিকেট বলে এখন
বাজারে বিক্রি করছে। এ চাল কথিত মিনিকেটের চেয়ে আরো বেশি চিকন।”
তিনি আরো বলেন, “দেশব্যাপী মিনিকেট চালের নামে যে চালবাজি চলছে তা
কেবল ক্রেতাদের মাঝে সচেতনা বাড়লেই নিরসন সম্ভব।”
কৃষিবিদ ড. মো. শমসের আলী বলেন, “মিনিকেট নামে কোনো জাতের ধান
বাংলাদেশে নেই। এটি প্রতারণা। এ প্রতারণার হাত থেকে বাঁচতে হলে সচেতনতার পাশাপাশি
আমাদের সৎ হতে হবে। চাল ব্যবসায়ীরা আসল পরিচয়ে চাল বিক্রি করলে ক্রেতারা প্রতারিত
হবে না।”
তিনি আরো বলেন, “আমাদের চাল বাজারগুলো ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে
তারা ইচ্ছা মতো চালের নাম দিয়ে বাজারে বিক্রি করছে।”
No comments:
Post a Comment